ঢাকা

No edit

সংবাদ শিরোনাম ::
ঢাকাঃ

No edit

সংবাদ শিরোনাম ::
Header Ads

মুদ্রাবাজারে অস্থিরতা কাটছে না

প্রকাশঃ
অ+ অ-
অর্থ-বাণিজ্য ডেস্ক : চাহিদার তুলনায় ডলারের সরবরাহ কম। নানা পদক্ষেপেও মুদ্রাবাজারে অস্থিরতা কাটছে না। চাহিদা মেটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংকগুলোর কাছে প্রচুর ডলার বিক্রি করছে। যার বিপরীতে টাকা আসছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে। এতে করে টাকার তারল্যে টান পড়েছে। আবার বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি বেড়ে প্রায় ১৪ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে; যা মুদ্রানীতিতে ঘোষিত লক্ষ্যের প্রায় সমান। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতির বাড়ায় কাঙ্ক্ষিত আমানত পাচ্ছে না ব্যাংকগুলো। সব মিলিয়ে ব্যাংকগুলোতে উদ্বৃত্ত তারল্য কমছে। নগদ টাকার সংকট মেটাতে অনেক ব্যাংক কলমানির পাশাপাশি এখন নিয়মিতভাবে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ধার করে চলছে।

বেশ কয়েক মাস ধরে ডলারের চাহিদা বাড়ায় বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করেই চলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ডলার বিক্রি করে বাজার থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের টাকা তুলে নেয়ায় এবং আমানতের পরিমাণ কমে যাওয়ায় ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট বা নগদ টাকার এই সংকট দেখা দিয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত আগস্ট শেষে ব্যাংক খাতে উদ্বৃত্ত তারল্য ১ লাখ ৭৪ হাজার ১৭৭ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। জুন শেষে এই তারল্য ছিল ২ লাখ ৩ হাজার ৪২৪ কোটি টাকা। জুলাইয়ে ১ লাখ ৮৮ হাজার ৭২৫ কোটি টাকায় নামে। আগস্টে কমেছে আরও ১৪ হাজার কোটি টাকা। গত বছরের আগস্ট শেষে ব্যাংক খাতে উদ্বৃত্ত তারল্য ছিল ২ লাখ ৩১ হাজার কোটি টাকার বেশি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের ৬ অক্টোবর পর্যন্ত (৩ মাস ৬ দিন) রিজার্ভ থেকে বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে ৩৭৫ কোটি ডলারের বেশি বিক্রি করা হয়েছে। বিক্রির বিপরীতে বাজার থেকে ৩৬ হাজার কোটি টাকার বেশি উঠে এসেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে। গত ২০২১-২২ অর্থবছর ৭৬২ কোটি ডলার বিক্রির বিপরীতে বাজার থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ঢোকে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে আবার গত আগস্টে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবৃদ্ধি বেড়ে ১৪ দশমিক শূন্য সাত শতাংশ হয়েছে, যা ৪৫ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। গত জুলাই শেষে প্রবৃদ্ধি ছিল ১৩ দশমিক ৯৫ শতাংশ। সাধারণভাবে বিনিয়োগ বৃদ্ধির প্রভাবে বেসরকারি খাতে ঋণ বাড়ে। তবে এখন বাড়ছে মূলত আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দর বৃদ্ধি এবং ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, কয়েক মাস ধরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজার থেকে ডলার উঠিয়ে নিচ্ছে আবার অন্যদিকে আমানতের পরিমাণও কমেছে। এর ফলে ব্যাংকে নগদ টাকার সংকট তৈরি হয়েছে। ভবিষ্যতে আরও বাড়তে পারে। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতি ব্যাপক বেড়ে যাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে ব্যাংকগুলোতে আমানত তেমন বাড়ছে না। এতে করে কমে আসছে ব্যাংক খাতের উদ্বৃত্ত তারল্য।

আমানত কমার কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় খরচ বেড়ে গেছে। ফলে ব্যাংকগুলোতে আগের কয়েক বছরের থেকে আমানত কমে গেছে।

অর্থনীতির গবেষক বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রানীতি সঠিকভাবে মেনে চলছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করা বন্ধ করতে হবে। কারণ এক বছরে রিজার্ভ ১০ বিলিয়ন ডলার কমে এখন ৩৬ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। তবে এটা বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব। প্রকৃত হিসাবে রিজার্ভ আরও ৮ বিলিয়ন ডলার কম, ২৮ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ জরুরি প্রয়োজনে আমরা ২৮ বিলিয়ন ডলার খরচ করতে পারব।’

হিসাব দিয়ে তিনি বলেন, ‘রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের (ইডিএফ) ৭ বিলিয়ন এবং অন্য আরও কয়েকটি প্রকল্পে ১ বিলিয়ন ডলার মোট ৮ বিলিয়ন ডলার বাদ দিলে আমাদের তাৎক্ষণিক খরচ মেটানোর রিজার্ভ আসলে ২৮ বিলিয়ন ডলার। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও (আইএমএফ) সেটাই বলছে।’

দীর্ঘদিন আইএমএফে গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করা এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করে টাকা তুলে নেয়া এবং মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকগুলোর আমানত কমে যাওয়ায় বাজারে নগদ অর্থের একটা ঘাটতি দেখা দিয়েছে। সরকার অবশ্য আশা করছে, আমন ধান বাজারে এলে মূল্যস্ফীতি নিম্নমুখী হবে। দেখা যাক কী হয়।’

‘তবে আমি আগেও বলেছি, এখনও বলছি, ডলারের তেজ কমাতে এবং মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে ব্যাংক ঋণের সুদের হার একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য হলেও বাড়ানো উচিত।’

আরেক অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘এ মুহূর্তে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ডলার ধরে রাখতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি বলে আমি মনে করছি।’

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সবশেষ তথ্যে জানা যায়, গত আগস্ট মাসে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসওয়ারি বা মাসভিত্তিক) দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতির পারদ ৯ দশমিক ৫ শতাংশে উঠেছিল; সেপ্টেম্বরে তা কমে ৯ দশমিক ১ শতাংশে নেমে এসেছে।

কমার পরও অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর এই সূচক ১২ বছর বা এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ। ২০১০-১১ অর্থবছরে দেশের গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১০ দশমিক ৯২ শতাংশ। এরপর আর এই সূচক ৯ শতাংশের ওপরে ওঠেনি।

বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২২-২৩ অর্থবছরের যে মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে, তাতে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ১৪ দশমিক ১০ শতাংশ।

আমানত বাড়ছে না

অর্থনীতির পরিভাষায় আয়ের তুলনায় ব্যয় বাড়লে মানুষের মধ্যে সঞ্চয় প্রবণতা কমে। কিন্তু মূল্যস্ফীতির চাপে সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকগুলোতে আশানুরূপ হারে আমানত বাড়ছে না। গত জুন পর্যন্ত এক বছরে আমানত মাত্র ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ বেড়ে ১৬ লাখ ২৪ হাজার ৪৭১ কোটি টাকা হয়েছে। এ সময় ঋণ ১৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ বেড়ে ১৩ লাখ ২০ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনার আলোকে ব্যক্তি পর্যায়ের মেয়াদি আমানতে ব্যাংকগুলোকে তিন মাস আগের গড় মূল্যস্ফীতির চেয়ে বেশি সুদ দিতে হচ্ছে। যদিও কোনো ব্যাংক ঋণে ৯ শতাংশের বেশি সুদ নিতে পারে না। তহবিল সংকট থাকায় কিছু ব্যাংক এখন দৈনন্দিন চাহিদার একটা অংশ মেটাচ্ছে আন্তঃব্যাংক ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার করে। এ ক্ষেত্রেও সুদহার বেড়েছে।

গত বৃহস্পতিবার শুধু কলমানি থেকে ব্যাংকগুলো ৭ হাজার ৮৫৬ কোটি টাকা ধার করে। একই দিনে রেপোর বিপরীতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেও বড় অঙ্কের ধার নিয়েছে। আমানত সংগ্রহে সুদহার বৃদ্ধির কারণে ঋণে ৯ শতাংশ সুদহারের সীমা পুনর্বিবেচনার দাবি জানিয়ে আসছে ব্যাংকগুলো। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাতে সায় দিচ্ছে না।

তবে ব্যাংকগুলোর উদ্বৃত্ত তারল্যের পুরোটাই অলস নয়। বরং এর বড় অংশই সরকারি বিল-বন্ডে বিনিয়োগ রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, প্রতিটি ব্যাংকের মোট আমানতের ৪ শতাংশ সিআরআর হিসেবে নগদে রাখতে হয়। আর এসএলআর বা বিধিবদ্ধ তারল্য হিসেবে প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলোকে ১৩ শতাংশ এবং ইসলামী ব্যাংকগুলোকে সাড়ে ৫ শতাংশ রাখতে হয়। সিআরআর ও এসএলআর সংরক্ষণের পর অতিরিক্ত অংশকে উদ্বৃত্ত তারল্য বলা হয়।

একটি মন্তব্য করুন