ঢাকা

No edit

সংবাদ শিরোনাম ::
ঢাকাঃ

No edit

সংবাদ শিরোনাম ::
Header Ads

কাব্যানুবাদ নিয়ে প্রকাশিত ফতোয়া ও আমার কিছু প্রশ্ন: আব্দুল্লাহিল বাকী

প্রকাশঃ
অ+ অ-

 


ইসলামী ও আরবি বিষয়ে একাডেমিক গবেষণার রীতি ও পদ্ধতি' বইটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। সেখান থেকে আমি প্রায়ই উপকৃত হই। বাংলাদেশে আগে ইসলামী ও আরবি বিষয়ে যেসব বিষয়ে গবেষণা হয়ে গেছে, সেসব গবেষণাপত্রের নাম এখানে উঠে এসেছে। পাশাপাশি নতুন কোন বিষয়ে গবেষণা করা যায়, সেটারও ধারণা দেওয়া হয়েছে। সেটা নবম অধ্যায়ে 'ইসলামি ও আরবি বিষয়ে গবেষণার প্রস্তাবিত শিরোনাম' এ আছে।
.
এই অধ্যায়ে ফিকহ ও উসূলে ফিকহের গবেষণার প্রস্তাবিত শিরোনামে একটা বিষয় যুক্ত করা হয়েছে, যা আমার পছন্দ হয়েছে। শিরোনামটা হল, "বাংলাদেশের বিভিন্ন দারুল ইফতা থেকে প্রদত্ত্ব ফাতওয়াসমূহের ফিকহী ও উসূলী বিশ্লেষণ"। এই বিশ্লেষণ যে কতটা জরুরি, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বাংলাদেশে যেসব ফাতওয়া দেওয়া হচ্ছে, সেগুলো হানাফি উসূলের ফিকহের আলোকে অধ্যয়ন ও বিশ্লেষণ করা দরকার।
.
মাওলানা ইযহারুল ইসলাম (যদিও তার কিছু বিষয়ের সাথে আমি একমত না) এক পোস্টে বলেছিলেন, "আমি চাই আকিদার ক্ষেত্রে কালামী ধারা এবং ফিকহের ক্ষেত্রে উসূলীধারা ফিরে আসুক। আকিদা ও ফিকহ উভয় ক্ষেত্রে সমস্ত বিক্ষিপ্ততার মূল হলো উসূলবিহীন জাহেরিয়্যাত বা বাহ্যিকবাদিতা এর চর্চা। আক্বিদা ও ফিকহের ক্ষেত্রে জাহেরী ধারা দূর হয়ে উসূলী-কালামী ধারা ফিরে আসুক এটাই আমার মূল লক্ষ্য।"
.
এই ধারার প্রয়োজনীয়তা আরো বেশি অনুভূত হচ্ছে, 'আওয়ার ইসলাম'-এ প্রকাশিত মাওলানা মুহিব খানের কাব্যানুবাদ নিয়ে এক ফতোয়া দেখে।
.
লেখক মাজমাউল আনহুর ও আলমগীরীর উদ্ধৃতি উল্লেখ করে বোঝালেন, কাব্যিক অনুবাদ কুফুরী। কিন্তু এর কারণ উল্লেখ করতে গিয়ে বললেন, “কুফুরীর কারণ হচ্ছে-কুরআনের কাব্যানুবাদ করলে কুরআনে কারিমের অবমাননা হয়।”
.
কিন্তু কিভাবে অবমাননা হয়, অবমাননার মানদণ্ড কী — সেসব লেখক বললেন না। আমার প্রশ্ন হল, যুগে যুগে কত মুসলিম কবি কোরানের বিভিন্ন বাণীর মর্ম ও তাৎপর্য নিয়ে কবিতা লিখে গেলেন, তারাও বুঝি কোরানের অবমাননাকারী ছিলেন। এমনকি সাহাবী হাসসান বিন সাবিত রাযি. সূরা তাওবার ১২৮ নং আয়াতের মর্ম নিয়েও কবিতা রচনা করেছিলেন। আয়াতটি হল, “তোমাদেরকে যা কিছু কষ্ট দেয় তা তার (রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিকট খুবই কষ্টদায়ক। তিনি তোমাদের কল্যাণকামী, মু’মিনদের প্রতি করুণাসিক্ত, বড়ই দয়ালু।”
.
এই আয়াতের মর্ম নিয়ে তিনি যে পংক্তি রচেছিলেন, তার বাংলা হল:
.
‘মানুষের সরল পথ থেকে বিচ্যুতি তাকে পীড়া দেয়।
তাই তিনি মনে প্রাণে কামনা করেন, মানুষ সত্য ও সুন্দরের পথে অবিচল থাকুক ও পথের দিশা লাভ করুক।’
.
তিনিও কি তাহলে কুরআনের অবমাননাকারী ছিলেন?
.
কেউ আপত্তি তুলতে পারেন যে, তারা তো এগুলোকে কোরানের মর্ম বলে দাবি করেননি। বা এটা তো সম্পূর্ণ কোরানের কাব্যানুবাদ ছিল না।
.
তখন বলব, তাহলে কি দাবি করা আর না করা নিয়ে অথবা আংশিক ও সামগ্রিক — এর কারণে ফতোয়া ভিন্ন হয়ে যাবে? একটা হয়ে যাবে প্রশংসনীয় আরেকটা হবে অবমাননা?
.
আরেকটা ইন্টারেস্টিং বিষয় হল, একদিকে তারা দাবি করবেন, ‘অবমাননা’র শান্তি ব্লাসফেমী অথচ এখানে তিনি ব্লাসফেমীর কোনও বিষয় আনছেন না — তাহলে এটা কেমন অবমাননা? তিনি আগে বেড়ে আরো বলেছেন,
.
“যদি কারো কুরআন অবমাননার ইচ্ছা না থাকে তাহলে তাকে কাফের আখ্যায়িত করা হবে না। তবে কুরআনের কাব্যানুবাদ করতে তাকে বাধা দেওয়া হবে। বাধা দেওয়া সত্ত্বেও যদি সে বিরত না থাকে তাহলে সে ফাসেক এবং মারাত্মক গুনাহগার হিসেবে বিবেচিত হবে। এ ধরনের কাব্যানুবাদ করা এবং প্রকাশ ও প্রচার করা সম্পূর্ণ হারাম।”
.
আমার প্রশ্ন হল, তাহলে অন্যান্যদের অবমাননার ক্ষেত্রে কেন তাদের ইচ্ছা দেখা হয় না? কিভাবে বুঝবে, তার অবমাননার ইচ্ছা ছিল নাকি ছিল না? বাধা দেওয়ার ক্ষেত্রে কে বাধা দিবে? সমাজ, রাষ্ট্র নাকি মুফতিগণ? অবমাননা যদি কুফুরি হয়, তাহলে তার প্রচার হারাম কেন হবে, কুফুরীর প্রচার কুফুরী কেন নয়? এসব প্রশ্নের কী উত্তর।
.
দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে যে বৈধতার ফতোয়া দেওয়া হয়েছে, সে সম্পর্কে লেখকের আপত্তি হল, “ফতোয়াটিতে কুরআনে কারিমের কাব্যানুবাদের ব্যাপক অনুমতি দেওয়া হয়নি; বরং শর্তসাপেক্ষে জায়েজ আখ্যায়িত করা হয়েছে। এখানে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে যে, সকল শর্তের ভিত্তিতে জায়েজ বলা হয়েছে সেগুলো খুব সহজলভ্য নয়। সুতরাং আরবি প্রবাদ ‘ইজা ফাতাশ শারতু ফাতাল মাশরুত’-এর ভিত্তিতে এটা নিয়ে সংশয় সৃষ্টি করার কোন সুযোগ নেই।”
.
তারমানে তিনি ধরেই নিচ্ছেন, শর্ত পূরণ করা হয়নি মুহিব খানের কাব্যানুবাদে। কিভাবে তিনি এমনটা ভাবছেন? তাছাড়া শর্ত পূরণ না হওয়ার কোনও উদাহরণও তিনি দেননি।
.
দেওবন্দের ফতোয়ার উপর তিনি আরেকটি আপত্তি করেছেন। বলেছেন, “এছাড়া হাকীমুল উম্মত, মুজাদ্দিদে মিল্লাত হজরত মাওলানা শাহ আশরাফ আলী থানভী (রহ.)-এর ফতোয়ার সাথে সাংঘর্ষিক হওয়ায় উভয় ফতোয়া ‘রাজেহ-মারজুহ’-এর মূলনীতি অনুযায়ী হাকীমুল উম্মতের ফতোয়াটি অগ্রগণ্য ও কার্যকর বলে বিবেচিত হবে।”
.
এখানে তিনি কিভাবে অগ্রগণ্যতা নির্ধারণ করবেন? অগ্রগণ্যতার ক্ষেত্রে যে তিনি এক ফতোয়াকে অগ্রাধিকার দিলেন, এটা কিসের ভিত্তিতে? কাওয়াদুশ শরীয়াহ ও উসূলের ফিকহ অনুযায়ী নাকি আকাবির হওয়া না হওয়ার ভিত্তিতে?
.
শেষের দিকে গিয়ে তিনি বললেন, “কুরআনের কাব্যানুবাদে তাহরীফে কুরআন বা কুরআন বিকৃত হওয়ার শুধু সম্ভাবনাই নেই; বরং অবশ্যম্ভাবী।”
.
কিভাবে তিনি কুরআন বিকৃতিকে অবশ্যম্ভাবী ধরে নিচ্ছেন? বেশির চেয়ে বেশি হয়ত, সম্ভাবনাযুক্ত বলতে পারতেন, অবশ্যম্ভাবী বলা মানে, যে ব্যক্তি এই অনুবাদ করবেন, তাকে কুরআনের বিকৃতিকারী হিসেবে স্বীদ্ধান্ত দিয়ে দেয়া। এই ধরণের ফ্যাসিবাদী কথা ও ফতোয়া দেয়ার আগে আল্লাহকে ভয় করা উচিত।
.
কাব্যানুবাদ আসলে তেমন কিছুই নয়। এটা কেবলমাত্র কুরআনের মর্মকে অন্ত্যমিলে ও সরস রচনায় রূপ দেওয়া। তাও আবার অন্য ভাষায়। খোদ আরবি ভাষায়ই অনেক কবি কুরআনের কিছু মর্মকে অন্ত্যমিলে রূপ দিয়েছেন। কাব্যানুবাদ করতে গেলে শব্দের আগ পিছ করতে হয়, স্বাভাবিক। তাই শব্দের আগ পিছ করা, কোনও নিন্দনীয় বিষয় নয়। কারণ, কুরআনের শব্দানুগ বা তারকীবানুগ অনুবাদ করা আবশ্যক নয়। বরং মর্মানুগ অনুবাদই যথেষ্ট। বিভিন্ন ভাষায় গদ্যে যেসব অনুবাদ হয়, সেসবেও মর্মানুগ অনুবাদ করতে গিয়ে আগপিছ করা হয়। কাব্যানুবাদ করতে গেলে মর্ম বাহ্যত হয় — এমন ধারণা করা ভুল। তবে হ্যাঁ… এমন হতে পারে যে কোনও কোনও পংক্তি মর্মের কম কাছাকাছি। এটাও স্বাভাবিক একটা বিষয়। গদ্যের অনুবাদেও এমনটা মাঝে মাঝে দেখা যায়। আদিব হুজুর ‘এসো কুরআন শিখি’ এর তৃতীয় ও চতুর্থ খণ্ডের তরজমা পর্যালোচনায় বিষয়টা সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলেছেন। তিনি থানবী ও শাইখুল হিন্দ রহ.এর তরজমাদুটো তুলনা করে দেখিয়েছেন, কখনো থানবী রহ.এর তরজমা কুরআনের মর্মের অধিক নিকটতর হয় কখনো শাইখুল হিন্দের তরজমা। কখনো আবার মর্মগত দূরত্বও থাকে। তখন আদিব হুজুর বুঝিয়ে দেন, কিভাবে এটা মর্মের কাছাকাছি হতে পারত।
.
বাকি থাকল ছন্দের বিষয়। ছন্দের ক্ষেত্রে বিকৃতি হবে — এটা মনে করাও ভুল। কারণ, ভাষায় এক শব্দের সমার্থক অনেক শব্দই থাকে। এক শব্দ না মিললে তার সমার্থক শব্দ আনা হয় ছন্দে। অথবা মর্মকে ঠিক রেখে শব্দের অগ্র-পশ্চাত করা হয়।
.
কাব্যানুবাদের ক্ষেত্রে যেসব আপত্তি করা হয়, সেসব আপত্তি গদ্যানুবাদের ক্ষেত্রেও অনেকে করে গেছেন। কাব্যানুবাদের ক্ষেত্রে যেমন ইখতেলাফ আছে, গদ্যানুবাদের ক্ষেত্রেও আছে। সেসবকে পিছনে রেখে সাহসিকতার সাথে উপমহাদেশে কুরআনের ফার্সি অনুবাদ এনেছিলেন শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী। তার দেখাদেখি, উর্দু হিন্দী বাংলায় অনেক অনুবাদ এসেছে। এখন তো প্রায় প্রতিটি ভাষায়ই কুরআনের অনুবাদ আছে।
.
অবশ্যই অনেকে থাকবে, যারা অনুবাদ করতে গিয়ে ভুল করবে বা বিচ্যুত হবে। কেউ এমনটা করলে তার ব্যাপারে অন্য কথা। তাই বলে, সামগ্রিকভাবে কুরআনের অনুবাদের বৈধতা ও অধিকার (হোক তা গদ্যানুবাদ বা পদ্যানুবাদ) হরণ করা উচিত নয়। বরং কুরআনের শিক্ষাকে ছড়িয়ে দিতে বেশি বেশি অনুবাদ প্রয়োজন। ভাষা নিয়মিতই পরিবর্তিত হচ্ছে, কয়েক যুগ আগে করা সাধু অনুবাদ বর্তমানের চলিত ভাষায় অভ্যস্ত মানুষদের ভাল লাগবে না। তাছাড়া অনেকে আছে, যাদের কাছে অন্ত্যমিলযুক্ত বাক্য বেশি ভাল লাগে। হৃদয়ে রেখাপাত করে। পদ্যানুবাদ তাদেরকে কুরআন পাঠে আগ্রহী করবে।

একটি মন্তব্য করুন