কালের কিংবদন্তি আল্লামা আবদুর রহমান কাশগরি (রহ.)
প্রকাশঃ
আল আমিন আজহার ➤
![]() |
| ফাইল ছবি |
আল্লামা আবদুর রহমান কাশগরি ছিলেন বিশ্বখ্যাত পণ্ডিত এক বিস্ময় পুরুষ। তাঁর জ্ঞানের গভীরতা ছিলো প্রবাদতুল্য।
আল্লামা কাশগরী ছিলেন মধ্য এশিয় মুসলিম জনপদের করুণ ও মর্মান্তিক ইতিহাসের একজন জীবন্ত সাক্ষী। হৃদয়ের গহীনে দুঃখ-বেদনার এক মহাসাগর বয়ে বেড়াতেন। বেদনার সেই তপ্ত লাভা সবসময় তিনি আড়াল করে রাখতেন।
আল্লামা কাশগরী ছিলেন চিরকুমার। তাঁর আত্মীয়-স্বজন পরিবার-পরিজন সম্পর্কে সেভাবে কিছুই বলা যায় না। কেবল এতোটুকুই জানা যায়, ১৯১২ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর তুর্কিস্তানের কাশগর নগরে তাঁর জন্ম হয়েছিলো। তাঁর পিতা ছিলেন একজন সামন্ত শাসক। কমিউনিস্টরা যখন বিপ্লবের নামে সে দেশে গণহত্যা নির্যাতন শুরু করে, আত্মরক্ষার জন্য তখন দলে দলে মানুষ দেশত্যাগ করে। সেই দেশত্যাগী মানুষের কাফেলায় শরিক হয়েই তিনি হিন্দুস্তানে এসেছিলেন।
আল্লামা কাশগরীর অতীত ছিলো খুবই দুঃখজাগানিয়া। কখনও যদি তিনি তাঁর কোনো ছাত্রের সামনে অতীতের স্মৃতিচারণ করতেন, তখন সেই শ্রোতার হৃদয়ও হুহু করে কেঁদে উঠতো। দু’চোখ বেয়ে অশ্রু ঢল নেমে আসতে অঝোরধারায়। অতীতের সেসব কথা মনে করে মাঝেমধ্যে তিনি উদাস হয়ে যেতেন। একাকী বসে ছোট বাচ্চার মতো ডুকরে কেঁদে ফেলতেন।
আল্লামা কাশগরীর বাবা ছিলেন কাশগরের সবচে’ ধনী ব্যক্তি এবং সকলের শ্রদ্ধাভাজন আলেম। বিপ্লবের নামে কমিউনিস্ট জালেমরা যখন সারা দেশের নেতৃস্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের ধরে নিয়ে যায়, তখন তারা আল্লামা কাশগরীর আব্বা, বড় ভাই ও বড় দুই বোনকেও তুলে নিয়ে যায়। আর কমিউনিস্টরা একবার যাকে তুলে নিয়ে যেতো, তার কোনো হদিস পাওয়া যেতো না। কাশগরীর আব্বা, বড় ভাই এবং দুই বোনের ক্ষেত্রেও এমনই ঘটেছিলো। তাদের কোথায় নেওয়া হয়েছে, এখন তারা কেমন আছে কিংবা আদৌ বেঁচে আছে কিনা, কোনো সংবাদ কখনোই আসেনি। তাদের যেসব ফলের বাগান, খামার, পশুপাল ও সম্পত্তি ছিলো, সবকিছুই কমিউনিস্টরা দখল করে নেয়।
আবদুর রহমান কাশগরী আর তাঁর আম্মাকে থাকার জন্য ছোট্ট একটা খামারবাড়ি দেওয়া হয়েছিলো মাত্র। কাশগরীর আম্মা স্বামী এবং সন্তান হারানোর শোকে ততোদিনে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছিলেন। ওই সময় কাশগরীর বয়স ১৪ কিংবা ১৫।
ভালো-মন্দ বিবেচনাবোধ তৈরি হয়েছিলো তাঁর। কমিউনিস্ট জালেমদের আঘাতে তারা যে একেবারে নিঃস্ব ও ধ্বংস হয়ে গেছে, এতোটুকু বুঝতে আপাতত অসুবিধা হয়নি।
এমন ভয়ার্ত সময়ে কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে একদল মুসলিম যুবক লুকিয়ে লুকিয়ে গেরিলা হামলা করছিলো। তাদের সফলতার খবরাখবরও আসছিলো। এতে কমিউনিস্ট জালেমরা আরও হিংস্র হয়ে ওঠে এবং শিশু-কিশোর নির্বিবাদে পাকড়াও শুরু করে।
এ সময় আবদুর রহমান কাশগরীর আম্মা তাঁর একমাত্র ছেলের জীবন নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েন। অবশেষে নিজের বুকে পাথর চাপা দিয়ে তিনি একমাত্র সন্তান কাশগরীকে হিন্দুস্তানগামী এক মুহাজির কাফেলার সঙ্গে পাঠিয়ে দিতে মনস্থির করেন। ভাবেন, চোখের আড়াল হোক; তবু আমার কলিজার টুকরো বেঁচে থাকুক।
আবদুর রহমান কাশগরী মুহাজির কাফেলার সঙ্গে হিন্দুস্তানের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার সময় আম্মাকে খুব অনুরোধ করেছিলেন তাঁর সঙ্গে বেরিয়ে পড়ার জন্য। কিন্তু তিনি তাঁর স্বামী ও অন্য সন্তানদের আশা তখনও ছাড়েননি। যদি তারা ফিরে আসে! বাড়ি ফিরে যদি তারা তাকে না পায়! এই আশায় এবং আশঙ্কায় আল্লামা কাশগরীর আম্মা সেদিন মুহাজির কাফেলার সঙ্গে হিন্দুস্তানগামী হতে পারেননি।
এক সন্ধ্যা রাত। চারপাশে আবছা অন্ধকার। আকাশে তখনও চাঁদ ওঠেনি। কিশোর আবদুর রহমান বেরিয়ে পড়েছেন হিন্দুস্তানের উদ্দেশ্যে মুহাজির কাফেলার সঙ্গে। অনেকটা পথ পেরুনোর পরও তিনি পেছনে ফিরে দেখতে পেলেন, দূরে টিলার ওপর দাঁড়িয়ে আম্মা করুণ চোখে তাকিয়ে আছেন তাঁর পথের দিকে। কাফেলা পাহাড়ের বাঁকে অদৃশ্য হওয়ার আগমুহূর্তে আবদুর রহমানের কানে আসে তাঁর আম্মার চিৎকার। আম্মা আবদুর রহমানের নাম ধরে ডাকছেন, ‘আবদুর রহমান.....! আবদুর রহমান.....!
তারপর থেকে মৃত্যুর দিন পর্যন্ত যখনই তিনি আনমনা হয়ে উঠতেন, কানে এসে আঘাত করতো আম্মার সেদিনকার চিৎকার। আবদুর রহমান, আবদুর রহমান, আবদুর রহমান বলে তিনি ডেকে চলেছেন।
হিন্দুস্তানে পৌঁছার পর ভাগ্যক্রমে লখনৌর নদওয়াতুল উলামার এতিমখানায় আশ্রয় হয় আবদুর রহমান কাশগরীর। দারুল উলুম নদওয়াতুল উলামা থেকে তিনি ১৯৩১ সালে বিশেষ কৃতিত্বের সঙ্গে সর্বোচ্চ ডিগ্রিতে প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন। নদওয়াতুল উলামাতেই তিনি আরবি সাহিত্যের শিক্ষক পদে নিয়োজিত হন।
শেরে বাংলা একে ফজলুল হক বাংলার শিক্ষামন্ত্রী হলে ১৯৩৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে একবার এক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে নদওয়াতুল উলামায় যান। সেখানে আল্লামা কাশগরীর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। কাশগরীর অসাধারণ পাণ্ডিত্যে তিনি যারপরনাই মুগ্ধ হন। তখন শেরে বাংলা আল্লামা কাশগরীকে ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে ইসলামি শিক্ষা ও সংস্কৃতি প্রসারের উদ্দেশ্যে বড় লার্ট ওয়ারেন হেস্টিংসের পৃষ্ঠপোষকতায় যে মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়, সেই কলকাতা মাদরাসা-ই-আলিয়ায় শিক্ষক হিসেবে যোগদানের জন্য অনুরোধ করলে আল্লামা কাশগরী রাজি হন। উসুলে ফিকহের অধ্যাপক পদে যোগদান করেন।
কালক্রমে কলকাতা আলিয়া মাদরাসাটি ১৯৪৮ সালে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়, তখন মাদরাসা কর্তৃপক্ষ তাকে লাইব্রেরির বইপত্র তদারকি করার জন্য নিযুক্ত করেন। তখন আল্লামা কাশগরী (রহ.) কলকাতা ছেড়ে ঢাকায় চলে আসেন এবং লাইব্রেরি তদারকি করেন।
এখানে দীর্ঘদিন অধ্যাপনার পর ১৯৫৬ সালে তিনি সহকারী হেড মাওলানা পদে নিযুক্ত হন। পরবর্তীতে আল্লামা কাশগরী (রহ.) ১৯৬৯ সালে হেড মাওলানা পদে উন্নীত হন। তিনি ছিলেন শিক্ষকমণ্ডলির শিক্ষক। তাঁর উপাধি ছিলো ‘উস্তাজুল আসাতিজা।’
আল্লামা কাশগরী আরবি সাহিত্যের একজন নামকরা লেখক ছিলেন। তাঁর রচিত কাব্যগ্রন্থ 'আজ জাহরাত' কায়রোর একটি বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা থেকে প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর রচিত অনেক গ্রন্থ মাদরাসা-ই-আলিয়ার লাইব্রেরিতে পাওয়া যায়। কিতাবুল হাদিকা, কিতাবুল মুফীদ, আল ইবরাত, আয যাহরাত আশ শাযারাত, মুহিককুন নাকদ, আল মাহবাব ফিল মুযাককার ইত্যাদি। তাঁর রচিত অনেক বই দেশের বিভিন্ন মাদরাসার পাঠ্য ছিলো। তিনি 'আল মুফিদ' নামে একটি অভিধানও সংকলন করেছিলেন।
মৃত্যু পর্যন্ত তিনি ঢাকা আলিয়াতেই কর্মরত ছিলেন। এমন দুঃখ নদী হৃদয়ে বয়ে বেঁচে ছিলেন আল্লামা আবদুর রহমান কাশগরী। এই চিরদুখী মানুষটার আপন বলতে কেউ ছিলো না। হোস্টেলের ছেলেগুলোকেই তিনি আপন মনে করতেন। ১৯৭১ সালে তিনি ঢাকা শহরেই ইন্তেকাল করেছেন। আজিমপুর কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।
শেরে বাংলা একে ফজলুল হক জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আল্লামা কাশগরী সাহেবের খোঁজখবর রেখেছেন। ভুলে যাননি। তাঁকে তিনি আন্তরিকভাবেই ভালোবাসতেন।

Post a Comment