অসুখপাখি
প্রকাশঃ
তাজুল ইসলাম ➤
![]() |
| প্রচ্ছদ : কাজী হাসানুল বান্না |
আজকাল বুক ভরে সেই নিশ্বাসটা আর নিতে পারছি না। কেউ জিজ্ঞেস করলে মুচকি হেসে বলতে পারছি না—‘এইতো ভালো আছি। দিব্যি চলছে সব।’ সারাদিনকার ব্যস্ততা সেরে রাতে পরিবারের সবার সঙ্গে বসে পঞ্চব্যঞ্জনে ভাত মেখে কব্জি ডুবিয়ে খাইনি বহুদিন৷ এক আকাশ চিন্তা আর মুখ ভর্তি বিষণ্নতার ছাপ নিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিই প্রতি রাতে। শিয়রে ইনহিলারটা রাখতে ভুল হয় না। হৃদযন্ত্রটা যে বড্ডো শরীরবিরোধী হয়ে উঠেছে। সময়ের তালে তালে সে আজ ভীষণ অদখলে।
রাতের আঁধার নামলেই আঁধার নামে জীবনে। দিনে তারচে’ বেশি। তারচে’ ভয়ঙ্কর। নির্ঘুম প্রতিটা রাত যতোটা না কষ্টের, তারচে’ বেশি ভয়ের। তারচে' বেশি শঙ্কার৷ এই বুঝি ভোরের বিষাক্ত আলো ফুটবে। হ্যাঁ, অত্যন্ত বিষাক্ত। সে আলো গায় মাখতে বড্ডো ভয় হয়—যদি কেড়ে নেয় সর্বস্ব!
পাখির কিচিরমিচির ডাকে যেই আমার রোজ ঘুম ভাঙতো, সেই আমি আজ রীতিমতো কেঁপে উঠি। শিউরে ওঠে সারা গা—আরেকটা খুন হলো না তো শহরের বুকে! যার বুকফাটা আর্তনাদে আকাশ-পাতাল এক হয়ে গেছে। কারোর বুকে আবার ছোঁড়া বসালো না তো ওরা! যা দেখে ডাস্টবিনের কাকগুলোও কাঁদতে কাঁদতে শহর ছেড়ে পালিয়ে আসে গ্রামে। কালো কালো কাক। বড্ডো কুচকুচে। আমি তাই জানালায়ও খিল এঁটে দিই। কাকে যে আমার ভীষণ ভয়। পাখিদের আর্তনাদে আমারও যে বুক ফাটে। আঁচড় কাটে।
গাঁয়ের নদীতে স্নানে যাওয়া হয় না বহুদিন হলো। কে জানে—কখন লাশ ভাসতে দেখবো! কে-ই বা বলতে পারে—নদীর জলেই স্নান হবে? কারোর রক্তেও তো হতে পারে! তাই অমন সুন্দর নদীর জন্য মনটা বড্ডো হু হু করে কাঁদে।
বয়সটা ষাটের কাঁধে গিয়ে চেপে বসেছে। আজকাল কি আর সেই জোর-বল আছে গায়! তবুও রুটিরুজির তাগিদে ছুটতে হয়। এখনও কতো দায়িত্ব কাঁধে চাপা! সংসার চালানো, ছেলেমেয়ের পড়াশুনোর খরচা, মাস শেষে তাদের হোস্টেলে টাকা পাঠানো, মেয়ে বড়ো হয়েছে, তাকে বিয়ে দিতে হবে। আরও যে কতো কি! হাঃ...! আর পেরে উঠছি না। তবু পিছপা হই না। নিজেই নিজেকে সাহস যোগাই। ভরসা খুঁজে পাই—‘ছেলেটা আমার বড়ো হয়েছে। মেয়েটাও শিক্ষিতা হচ্ছে। ভালো চাকরি, ভালো একটা জামাইও জুটবে নিশ্চয়ই।’
কতো ভাবনা মনে! কতো রঙিন রঙিন স্বপ্ন চোখের তারায়! কতো দায়িত্ব! তবে এসবে মোটেও ভয় নেই। ভয় তো অন্যকিছুতে। ভয় হয়, যখনই বুকপকেটে ফোনটা বেজে ওঠে। ওপাশ থেকে যদি কেউ খারাপ খবর শুনিয়ে দেয়! যদি কেউ জানতে চায়—আমিই রাব্বির বাবা কিনা? পরক্ষণেই যদি বলে ওঠে, রাব্বি আর নেই! ওর বন্ধুরা ওকে মেরে ফেলেছে!
ভয়ে একটা খবরের কাগজ পর্যন্ত পড়তে পারি না আজকাল। কে বলতে পারে, তাতে আত্মহত্যা কিংবা খুনের খবর ছাপা থাকবে না! টিভির সামনে বসতেও আজকাল বুকটা কেমন ধুকপুক করে। কে বলতে পারে, ব্রেকিং নিউজটা ধর্ষণের হবে না? মেয়েটা যে আমার শহরে থেকে পড়ে! বড়ো আদরের একমাত্র মেয়ে আমার।
ভয় হয়, ঘরের বাইরে পা রাখতে; যদি আর ফেরা না হয়! যদি কারো সন্দেহের বলি হতে হয়! বড্ডো চিন্তা হয়, যখন শুনি কেউ কোট-কাচারি করছে; বিচারের আশায় অঘোরে প্রাণটা না যায়! বিচার যে অর্থবল আর ক্ষমতাবলের কাছে জিম্মি। সেও যে নিভৃতে হু হু করে কাঁদে! ভীষণ কাঁদে—আমি যেমন ডুকরে কাঁদি।
চিরচেনা চারপাশটাও যখন-তখন ভীষণ অচেনা হয়ে পড়ে। কাঁটাতারের বেড়া ডিঙিয়ে যেতে বড্ডো ভয় হয়—আমি যে ধর্ষিতার বাবা! ধিক্কার আর গঞ্জনায় বিষে ওঠে আমার আপাদমস্তক। নত শির হয়ে ফিরে চলি টর্চার সেলে—স্মৃতিঘেরা শূন্যগৃহে। সত্যিই চারপাশটা কতো অচেনা!
কতো আনন্দ, হৈ হুল্লোড়ে ভরা ছিলো বাড়ির আঙিনার সমস্তটাজুড়ে। আজ তা শূন্য। নিথর। নিস্তব্ধ। কতো স্বপ্ন ছিলো দু’চোখজুড়ে! আজ তা অশ্রুসিক্ত। আলো ঝলমলে ছিলো যে গৃহের প্রতিটা কোণ, তা আজ আঁধারে আচ্ছন্ন! আঁধার যে আজ বড়ো আপন! একমাত্র সান্ত্বনা।
রাতের আঁধার নামলেই আঁধার নামে জীবনে। ঘুটঘুটে কালো আঁধারে হরদম চলে ধর্ষণ। চলে খুন, ছিনতাই, রাহাজানি। রাতের আঁধারে শূন্য হয় কতো বুক! কতো বুক আবার মৃত স্বপ্নের এপিটাফ বনে যায় রাতারাতি! তবুও যে আঁধার বড্ডো ভালোর। পরম সান্ত্বনার; আঁধারে আঁধার নামে, প্রকাশ্য দিবালোকে তো নয়!
আঁধার আলো—এভাবেই প্রতিনিয়ত জীবন নিয়ে খেলছে তোমার, আমার, আমাদের সবার। প্রতিনিয়ত চোখে স্বপ্ন আঁকি আর বুকে তা দাফন করি। নিয়তি সর্বত্র ঠকিয়ে চলে মানুষকে। বিচারের নামে চলে প্রহসন। হতাশা রাতের আঁধারের মতোই ঘিরে ধরে চারপাশ।
লাল-সবুজের কফিনে চড়ে রোজ রোজ কেউ না কেউ ঠিকই পাড়ি জমায় মৃত্যুপুরীর ঠিকানায়। শুধু তুমি, আমি, আমরা কিংবা আমাদের মতো অনেকেই রয়ে যায় ‘জীবন-মৃত্যু’ নামক পরিবহন জ্যামে।
তাইতো আজকাল কেউ জিজ্ঞেস করলে আর বলতে পারছি না—‘এইতো ভালো আছি। দিব্যি আছি।’ কিভাবেই বা বলি? ভালো যে নেই মোটেও! তুমি, আমি, আমরা কেউ-ই ভালো নেই! কেউ না!
লেখক : গদ্যশিল্পী, কবি ও গল্পকার
শিক্ষার্থী : অনার্স (তৃতীয় বর্ষ), ইংরেজি সাহিত্য বিভাগ, সরকারি বঙ্গবন্ধু কলেজ, গোপালগঞ্জ

Post a Comment