বাজাননামা
প্রকাশঃ
মুহিউদ্দিন সাইফ ➤
ক’দিন আগে খবর পেলাম, বাজান অসুস্থ। আমার প্রিয় বাজানের পক্স উঠেছে। ভাবলাম, একটু সাক্ষাৎ করতে যাবো। কিন্তু সময় আর মনের কারণে বাঁধ সাধলো। মন চায় তো সময় নেই, সময় এসে হাজির তো মনে নেই। এই করে যাওয়া হলো না। আজ এরাদা করলাম, যাবোই যাবো।
আসরের আগেই চলে গেলাম বাজারে। কয়েকটি রসগোল্লা নিয়ে এলাম। দুরু দুরু বুকে হাঁটিহাঁটি পায়ে বাসায় ঢুকলাম। দরোজায় দাঁড়িয়ে আওয়াজ দিলাম। সালাম করলাম। একবার, দু’বার। ভেতর থেকে ছোট্ট সাফওয়ানের আওয়াজ এলো। দরোজা খুলে দিলো। বললাম, ‘আব্বু কোথায়?’ বললো, ‘বাসায় নেই, মাদরাসায় গেছেন।’ প্যাকেটটা ওর সামনে এগিয়ে দিলাম। প্রথমে কিছুটা অসম্মতি দেখালো, পরে নিলো।
ফিরে এলাম মাদরাসায়। হুজুর যে কামরায় থাকেন, সেখানে গেলাম। কিন্তু পেলাম না। কিছুটা পেরেশান হলাম। ভাবলাম, হয়তো শিক্ষাদপ্তরে আছেন। একটু গিয়ে দেখি। সিঁড়ি ভেঙ্গে নিচে নেমে এলাম। দরোজার ফাঁক গলে উঁকি মারলাম। দেখি, বসে আছেন। দরোজায় দাঁড়িয়ে সালাম দিলাম। উত্তর দিয়ে ঢোকার অনুমতি দিলেন। কাছে গেলাম। পাশে বসলাম। কয়েকদিনের অসুস্থতায় এখনও পরীক্ষার প্রশ্নপত্র জমা দিতে পারেননি। তাই প্রশ্ন প্রস্তুত করছেন।
আমার উপস্থিতি এ মুহূর্তে আমার বাজানের জন্য কেমন! জানা নেই। আমার তো আশা আনন্দদায়কই হয়তো। কারণ আমার প্রিয় বাজান এমনই, অধিকাংশ সময় পার করেন ছাত্রদের পরশে। বাগানের মালি যেমন দিনরাত পার করে দেয় তার বাগান পরিচর্যায়, ঠিক তেমনি। বরং তার চেয়েও বেশি সময় কাটান প্রিয় ছাত্রদের পরিচর্যায়। ভালো কিছু আদেশ, উপদেশ, তরবিয়ত দিতে থাকেন; দিয়ে যান অনবরত।
আমার প্রিয় বাজান ছাত্র গড়ার একনিষ্ঠ কারিগর এবং অনন্য ব্যক্তিত্বের অধিকারী। তিনি আমার জীবনের সফল শিক্ষক। তিনি আমার গুরু। তিনি আমার মনিব। তিনি আমার রাহবার। তিনি আমার মুকতাদা।
কিছু সময় কথা বলে জানালাম, বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছি। হাদিয়ার কথা শুনে খুব খুশি হলেন। দোয়া দিলেন। আমিও দিনটি খুব আনন্দে যাপন করলাম।
২১ জিলকদ ১৪৪১
আট দিন পূর্ণ হলো, পূর্বের মাদরাসায় আবার দাখেলা পেলাম; আলহামদুলিল্লাহ। দীর্ঘ অপেক্ষার পর আজ সাক্ষাৎ করলাম প্রিয় বাজানের সঙ্গে। সাক্ষাতের পর অজান্তেই গালবেয়ে দু’ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। হায়, আমার জন্য বাজানের হৃদয়ে এখনও আছে এতো দরদ! অথচ বাজানের জন্য আমার অন্তরে...। মোটামুটি অনেক কিছুরই খোঁজখবর নিলেন।
এ ক’দিন দূর থেকেই শুধু দেখেছি বাজানকে। কাছে গিয়ে সামনে দাঁড়াবার সুযোগ আর সাহসটুকু হয়নি। আজকে আমার এই যা কিছু অর্জন, তা কেবল আমার প্রিয় বাজানের অবদানেই। কী অবদান, তা হয়তো বলে বুঝাতে পারবো না। প্রথম বর্ষে কাসাসুন নাবিয়্যিনের দরস, মাঝেমধ্যে বিভিন্ন আদেশ-উপদেশ, এসবেরই অবদান রয়েছে আমাকে মানুষ করার পেছনে।
প্রিয় বাজানকে ঘিরে কিছু স্মৃতি
১. প্রথম বর্ষের দাখেলার দিন তার সঙ্গে কথা বলার সেই হাসিমাখা স্মৃতিটুকু আজও আমায় আনন্দিত করে তোলে।
২. রাতে ঘুমের পূর্বে একদিন ডেকে জামা ধোয়ার জন্য একটি ব্যাগ এগিয়ে দিলেন। আমিও সে সুযোগ পরমানন্দে লুফে নিলাম।
৩. দ্বিতীয় বর্ষে একদিন কাউকে দিয়ে খবর দিলেন, প্রতিরাতে খেজুর টুকরো টুকরো করে যেনো ভিজিয়ে রাখি। তখন আমিও বেশ ক’দিন আনন্দচিত্তে এ খেদমতটুকু করে দিতাম।
৪. একদিন বাজান খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেন। খবর পেয়ে ছুটে গেলাম বাজারে। সামান্য কিছু হাদিয়া নিয়ে দেখা করলাম। হাসিমুখে তিনি হাদিয়াটুকু গ্রহণ করলেন। আর আমারও তখন আনন্দের জোয়ার বয়ে গেলো।
আল্লাহ শুধু তাঁর প্রিয় বান্দাদেরকেই পরীক্ষা করে থাকেন। আমার প্রিয় বাজানের প্রিয় ছেলে সাফওয়ান এই গেলো ঈদের দিন আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেছে। (যতোটা সহজভাবে বলা হলো, এমনই সহজভাবে ছোট্ট সাফওয়ান আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেছে)।
ছেলের বিচ্ছেদে হয়তো মনের দুঃখগুলো বারবার উথলে উঠছে। আল্লাহতায়ালা আমার প্রিয় বাজান হুজুরকে সবরে জামিল দান করেন এবং তার গোটা পরিবারকে সবর করার তৌফিক দান করেন। আর ছোট্ট সাফওয়ানকে জান্নাতের অতিথি হিসেবে কবুল করেন। আমিন।
লেখক : ফাজেল, আল জামিআতুল ইসলামিয়া (ভবানিপুর মাদরাসা), গোপালগঞ্জ

Post a Comment