ঢাকা

No edit

সংবাদ শিরোনাম ::
ঢাকাঃ

No edit

সংবাদ শিরোনাম ::
Header Ads

মায়াজাল

প্রকাশঃ
অ+ অ-
মুহাম্মদুল্লাহ ইয়াসিন 

প্রচ্ছদ : কাজী হাসানুল বান্না

গেলো বারের কথা। প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখা শেষে খেদমতের প্রথম বছর। স্নেহশীল উস্তাদ মাসুম বিল্লাহ সাহেব আমার জীবনের এ প্রথম খেদমতটি ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। যোগ-বিয়োগের মধ্যদিয়ে বছর শেষ করতে যাবো, তখনই এলো করোনা। দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষা আসার আগেই করোনার মহাপরীক্ষা দেখা দিলো। মাদরাসার পাশাপাশি বন্ধ ঘোষণা করা হলো গোটা দেশ। 

অনেকদিন পরে বাড়ি যাওয়া হবে ভেবে  মন একরকম খুশিই ছিলো বৈকি! বাড়ি ফেরার পর বারবার যখন বহুল ব্যবহৃত নতুন শব্দ ‘লকডাউন’ সামনে এলো, তখনই মাদরাসায় ফেরার চিন্তা সুদূর পরাহত হলো। একমাস, দু’মাস করতে করতে বরকতময় রমজানও কাটাতে হলো বাড়ি। রোজা রেখে ইরিধান কেটে মাথায় করে রোদে পুড়ে বাড়ি আনতে লাগলাম। এভাবে আমার শিক্ষকতার প্রথম বছর শেষ হলো।

এমন দুর্দিনে আকবর কমপ্লেক্সের দাওরার সহপাঠী ইউসুফ ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তাঁর নব প্রতিষ্ঠিত হাকিমুল উম্মাহ মডেল মাদরাসায় আমাকে নামেমাত্র অজিফায় নিয়োগ দেওয়া হলো। তবে অন্য কোনো মাদরাসায় খেদমতের ব্যবস্থা হলে চলে যাবো। এমন সিদ্ধান্ত ভেতরে ভেতরে রাখলাম। এভাবেই যাত্রা আরম্ভ কোনো সহপাঠীর অধীনে খেদমত করার নতুন অভিজ্ঞতার বছর।

ইউসুফ ভাই ছাত্রাবস্থায়ই বিয়েকর্ম সেরে ফেলেছিলেন।  আহলিয়া অনুমতি দিলে আরও তিনটে শাদি করার তীব্র চাহিদা এখনও লালন করেন তিনি। তাঁর দু’মেয়েআয়েশা ও আমাতুল্লাহ। একজনের বয়স ছয়, অন্যজনের দেড় বছর। ইউসুফ ভাই মসজিদে নামাজ পড়াতে গেলে আমাতুল্লাহ, আয়েশা আমার কাছেই থাকতো। প্রথম প্রথম  খুব বিরক্ত লাগতো। কিন্তু লোকলজ্জায় প্রকাশ করিনি। কিছুদিন গেলে অবশ্য বিরক্তি চলে গেলো। ভালোবাসতে শিখে ফেললাম। বুঝে গেলাম সন্তান প্রতিপালনও। এদিকে তাঁর আহলিয়াও সুযোগ পেয়ে ওদের লালন-পালনের ভার অঘোষিতভাবে যেনো আমায় দিয়ে রাখলেন।

দু’সন্তানের মাঝে আমাতুল্লাহকেই বেশি আদর করতাম। যতো বেশি আদর বাড়ে, ততো বেশি কাছাকাছি চলে আসতো আমাতুল্লাহ। দেড় বছরের আমাতুল্লাহ তখন আমাকে ছাড়া কিচ্ছু বুঝতো না। সকালের নাশতা, দুপুর ও রাতের খাবারের সময় মা-বাবাকে চিনতো না। তাদের পাশে বসে খেলেও তেমন করে খেতো না। আমার আসনটি নিজের চেয়ার ভেবে তার ওপর বসে  না খেলে  ওর পেট ভরতো না। স্নেহ-মমতা আর ভালোবাসার তীব্রতা এতোটাই বেড়ে গেলো, আমাতুল্লাহকে যদি ওর বাবা-মা কেউ বকা দিতো, তাহলে আমার কাছে এসে ভাঙা ভাঙা ভাষায় বিচার দিতো। আমি সান্ত্বনা দিতাম। আদর করতাম। সান্ত্বনা পেয়ে খুব খুশি হতো। হাসতো। আমার কাঁধে চড়ে খেলতো। চুল টানতো। 

মাঝেমধ্যে ওর বাবা-মা কোনো খবরই নিতো না। আমিই ওকে গোসল করিয়ে দিতাম। তেল মেখে দিতাম। খাইয়ে দিতাম। এতে করে ওর বাবা কে, তা যেনো ভুলেই গেলো। মনে পড়তো শুধু রাতে ঘুমের সময়।

একদিন তিনদিনের ছুটিতে বাড়ি ফিরবো। সবার কাছ থেকে দোয়া নিয়ে ব্যাগ হাতে বেরুলাম। আমাতুল্লাহকে বললাম, ‘আমি বাড়ি যাচ্ছি। আবার চলে আসবো, ইনশাআল্লাহ।’ কথাটি শুনে ও মাটিতে লুটিয়ে পড়ে কান্না জুড়ে দিলো। সে কী কান্না! আমায় একা যেতে দেবে না। দেবে না তো দেবেই না। ও-ও যাবে আমার সঙ্গে। আমার ব্যাগ রেখে দেবে। অথচ ওর বয়স তখন পৌনে দু’বছর।

শেষমেষ কাজিপাড়া মোড় পর্যন্ত ওকে সঙ্গে করে এলাম। দোকান থেকে আয়েশা আর ওকে চিপ্স কিনে দিলাম। বাচ্চা মনে তখনও হয়তো ভাবছিলো, ওকে নিয়ে যাবো আমার সঙ্গে। তাই মনে মনে খুব খুশি ছিলো। পরে যখন অটোতে চড়লাম, আর ওকে আমার কোল থেকে এক ছাত্রের কোলে দিলাম, তখন বাচ্চাটা এমনভাবে কান্না শুরু করলো! হেচকি উঠে গেলো। সেদিন কাঁদতে কাঁদতে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ হয়ে গেলো। না খেয়েই শুয়ে পড়লো।

আমাতুল্লাহকে ওর বাবা-মা মাঝেমধ্যে জিজ্ঞেস করতো, ‘তুমি কার?’ ও বলতো, ‘আমি হুজুরের।’ আবার জিজ্ঞেস করতো, ‘তোমাকে কে বেশি আদর করে?’ জবাবে নিষ্পাপ মেয়েটি বলতো, ‘হুজুর।’ আমি একবেলা মসজিদে নামাজ পড়াতে গেলে সাইকেলে করে ওকে নিয়ে যাওয়া লাগতো। না নিলে রাস্তায় শুয়ে কান্নাকাটি করতো। এভাবেই দিনে দিনে আমার কলিজায় আসন গেড়ে নিলো আমাতুল্লাহ। ওর বাবা-মা ওকে কিছু খেতে দিলে বলতো, ‘হুজুরের তা কই?’ হুজুরকে না দিলে ও রাগ করে মুখ ঢেকে রাখতো হাত দিয়ে। কিছুই খেতো না নিজ হাতে আমাকে না দেওয়া অবধি।
 
আমি মাদরাসার অফিসে ঘুমোতাম। যখন সেখানকার রিজিক ফুরিয়ে এলো, তখন আমাতুল্লাহ নাকি আমাকে রোজ তালাশ করতো। যখনই মনে পড়তো, তখনই অফিসের দরোজায় এসে জোরে নক করতো। আমাকে ডাকাডাকি করতো। কান্নাভরা কণ্ঠে বলতো, ‘হুজুর! দরোজা খোলেন। আমি ভেতরে আসবো, আপনার কাছে।’ ডাকার পরেও যখন বুঝতো, হুজুর নেই; তখন মন খারাপ করে বাসায় চলে যেতো। আব্বু-আম্মুর কাছে জিজ্ঞেস করতো, ‘হুজুর! কোথায়? আমি হুজুরের কাছে যাবো।’

মাদরাসার আশপাশের সবাই বলাবলি করতো, হুজুর চলে গেছেন। এখন আর আমাতুল্লাহকে আদর করার কেউ নেই। নতুন হুজুরের কাছে নাকি আমার কথা আমাতুল্লাহ-আয়েশা মাঝেমধ্যে বলে, আমি নাকি অনেক আদর করতাম; মজা কিনে দিতাম।

আমাতুল্লাহ এখন তৃতীয় বছরে পা দিয়েছে। যশোরের মিষ্টি ভাষায় কথা বলে। শুনতে অনেক মিষ্টি ও সুমধুর। অনেকদিন বাদে আজ আমাতুল্লাহকে ভিডিওকলে দেখলাম। ওর আগের সবকিছু পুরোপুরি মনে নেই। এখন অল্প অল্প মনে আছে। বড়ো হলে কিছুই মনে থাকবে না হয়তো। আর আমি এখনও ভুলতে পারি না ওর কথা। আমাতুল্লাহ আমার কলিজার সঙ্গে জুড়ে থাকা একটা ছোট্ট সোনামণি। ওর দুরন্তপনা ও চঞ্চলতায় আমি সবসময়ই মুগ্ধ ছিলাম। আজ আমি ওর কাছে নেই।

ওর ছবি আমার ফোনে ভরপুর। কিন্তু কখনও ইচ্ছে করেই দেখতে চাই না। দেখলে সইতে পারি না এক ছোট্ট শিশুর বিচ্ছেদ ব্যথা। মনে চায়, এখনই চলে যাই ওকে দেখতে, আদর করতে। আজ অনেকদিন পরে ওকে দেখে আমার চোখে জল এসে গেলো। ভেতরটা ভেঙ্গে খান খান হবার উপক্রম। বয়সের কারণে শুধু হাউমাউ করে কাঁদতে পারলাম না। এতোটা মায়া অন্য কোনো বাচ্চার জন্য আমার কখনও হয়নি। এমনকি ওর বড়ো বোন আয়েশার জন্যও না।

লেখক : শিক্ষাসচিব, কেয়টখালি ইসলামিয়া মাদরাসা ও এতিমখানা, মুন্সিগঞ্জ

একটি মন্তব্য করুন